বাংলাদেশ   বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪  

শিরোনাম

নোংরা-দুর্গন্ধময় রহমতখালীর পানি

দূষণে বিপর্যস্ত পরিবেশ ॥ জীববৈচিত্র ধ্বংস
uploads/reporter_image/Johirul_Islam.jpg

মো. জহিরুল ইসলাম

রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৫ পিএম   /    ৬৪ বার পড়া হয়েছে

নোংরা-দুর্গন্ধময় রহমতখালীর পানি

যে খালের পানিতে থাকার কথা মাছ ও বিভিন্ন ধরণের প্রাণী, সে পানিতে রয়েছে ময়লা আর্বজনা ও পোকামাকড়। যে পানি গোসলসহ গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার হতো, সে পানি এখনো কালো রং ধারণ করে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অস্তিত্ব হারিয়েছে জীববৈচিত্র্য, বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে পরিবেশ।

এ চিত্রটি লক্ষ্মীপুর শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী রহমাতখালী খালের। লক্ষ্মীপুর বাজার কেন্দ্রীক এ দৃশ্য দেখে মনে হবে খালটি রহমতের বদলে আশপাশের লোকজনের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে দখল এবং দূষণের ফলে এমন ভয়াবহ চিত্র খালটির। মানবসৃষ্ট সংকটে খালটি এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
একসময় রহমতখালি নদী বা রহমতখালি খাল বাংলাদেশের একটি ছোট নদী। এটির শুরু ফেনী থেকে, আর শেষ লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাটের মেঘনা নদীর মুখে। রহমতখালীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৫ মাইল বা ১৩৭ কিলোমিটার। প্রস্বস্ত ছিল প্রায় ১২৮ মিটার। এটিকে নদী নামে ডাকা হলেও কালের বিবর্তনে এটি খালে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু এখন সেই খালেরও অস্তিত্ব হারানোর পথে। দখলে-দুষণ এবং সংস্কারের অভাবে খালের বিভিন্ন স্থান সংকুচিত হয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে অনুযায়ী খালটির ৪০ কিলোমিটার লক্ষ্মীপুর অংশে। এটি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত।
এ খালটি বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি বোরো মৌসুমে মেঘনা নদী থেকে জোয়ারের পানি ঢুকে ইরি চাষাবাদের জন্য আর্শিবাদ ছিল। আর মৎস্যজীবিদেরও অয়ের উৎস্য ছিল খালের মাছ। তিন যুগ আগেও খাল দিয়ে চলাচল করতো মালবাহী নৌকা। এসব কিছু এখন যেন গল্পের মতো।

লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাজার, জকসিন বাজার, মান্দারী ও চন্দ্রগঞ্জ বাজার অংশে খালটি মানবসৃষ্ট দূষণের মধ্যে পড়েছে। পৌর শহর এলাকায় খালটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫ কিলোমিটার। এ অংশটি দূষণমূক্ত রাখার দায়িত্ব পৌর কর্তৃপরে। এজন্য প্রতি অর্থ বছরের এডিবির অর্থ বরাদ্দও হয়। কিন্তু খালটি কখনো দূষণমুক্ত হয়নি। তাই পৌর কর্তৃপকের দায়ি করছে স্থানীয় লোকজন। আবার পৌর কর্তৃপ দায়ি করছে পৌরবাসীর অসচেতনতাকে।  

খালের দুইপাড়ে থাকা বেশিরভাগ ভবনের সেফটিক ট্যাংকের লাইন খালের উপর। এতে মানববর্জ্য এসে পড়ছে খালের পানিতে। আবার কোন কোন ভবনের সেফটিক ট্যাংকের বর্জ্য পরিষ্কার করে ফেলা হয় খালে। আর গৃহস্থালির যত আর্বজনা রয়েছে, সবি খালের মধ্যে পড়েছে।

ভয়াবহ অবস্থা পৌরসভার বাজার এলাকা ও মান্দারী বাজার এলাকায়। এ দুই বাজার কেন্দ্রীক খালের অস্তিত্ব এখান এখন সংকটের মধ্যে। দখল এবং দূষণ সবচেয়ে বেশি এ দুটি স্থানে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রতমতখালী খালের প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ পৌর বাজারের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। বাজারের অংশ এখন আর্বজনায় ভরপুর। সেগুলো পঁচে পোকামাকড় কিলবিল করছে। আর পানির রং ধারণ করেছে কালো রংয়ে।

বাজারের গোশত হাটার কয়েকটি মুরগি দোকানের পেছনের অংশ রয়েছে খালের উপর। খোদ পৌর কর্তৃপ ওই দোকানগুলো নির্মাণ করেছে। বাজার ব্রিজ অংশের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশের ভবনগুলোর একাংশ খালের উপর। এতে ওইস্থান দিয়ে খালটি পুরো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। শহরের ঝুমুর সিনেমার সংলগ্ন পূর্ব অংশে দখল হয়ে আছে।

বিশেষ করে বাজারে গোশত হাটার পাশ দিয়ে থাকা খালের এ অংশটির কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে ভয়ানকভাবে। ওই অংশে গরু-ছাগল এবং হাঁস-মুগির বিষ্ঠা এবং এসব প্রাণী জবাইয়ের রক্ত ও উচ্ছিষ্ট সরাসরি পড়ছে খালের পানিতে। দোকানের মরা মুরগিও ফেলা হচ্ছে সেখানে। হোটেল রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট ফেলায় এগুলো পঁচে এখন পোকামাকড় কিলবিল করছে। ওই স্থান সংলগ্ন খাল পাড়ের বাসিন্দা বাদশা হোসেন। খালের ভয়াবহ দূষণের কারণে তাদের বসবাস করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

এজন্য বাজারের ব্যবসায়ী এবং পৌর কর্তৃপকের দায়ি করে বাদশা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে খাল। খালের পানিতে পোকামাকড়, মশামাছি, এবং দুর্গন্ধের কারণে আমাদের বসবাস করা কষ্ট হয়। শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাজারের এ অংশটি অন্তত পরিষ্কার রাখার জন্য আমরা বার বার পৌর মেয়রকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কখনো পরিষ্কার রাখা হয়নি। পৌর কর্তৃপ পারে বাজারের ব্যবসায়ীদের ময়লা আর্বজনা খালে না ফেলে অন্যত্র ফেলার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কখনো কোন কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি পৌরসভা।

খালপাড় সংলগ্ন বাসিন্দা ফাহাদ ও খলিল বলেন, বাজারের কয়েকটি স্থানে খাল দখল হয়ে আছে। বিভিন্ন ভবনের পেছনের অংশ খালের মধ্যে। এতে খাল সংকুচিত হয়ে গেছে। বাসাবাড়ি ও বাজারে ময়লা আর্বজনাতে খাল ভরাট হয়ে আছে। পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় খালের পানি ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে আছে।

মো. সুজন বলেন, বিভিন্ন বাসাবাড়ির সেফটিক ট্যাংকের পাইপ লাইন দেওয়া আছে খালের মধ্যে। এগুলো বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়না। এগুলো দেখার দায়িত্ব পৌর কর্তৃপ ও প্রশাসনের। খাল নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

খালপাড় সংলগ্ন উত্তর মজুপুর এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও আমরা খালের পানিতে গোসল করতাম। রান্না-বান্নার কাজে পানি ব্যবহার করা হতো। পানি একেবারে স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু এখন পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। পানির রং কালছে এবং ঘোলাটে। বাজার কেন্দ্রীক খাল বেশি দূষণের কারণে ওই দূষিত পানি পুরো খালে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিকমতো জোয়ারের পানিও ঢুকতে পারছে না।

তিনি আরো বলেন, আরখালের সাথে পৌর এলাকার সবগুলো ড্রেনেজ লাইনের মুখ। শহরের যত বাসাবাড়ি আছে, সবগুলোর ময়লা গিয়ে ড্রেনে পড়ে, আর ড্রেন থেকে সব বর্জ্য খালের পানিতে মিশে যাচ্ছে। এ পানি আবার মেঘনা নদীতে গিয়ে নদীর পানিও দূষণ করছে। এসব কিছুর জন্য তিনি ভবনের বাসিন্দা ও পৌরসভার ব্যর্থতাকে দায়ি করেছেন।
৬৫ বছর বয়সী সফিক উল্যা বলেন, এ খাল দিয়ে মালবাহী নৌকা চলতো। আমরা নিজেরাও খাল দিয়ে চলাচল করেছি। কিন্তু এখন খালের যে অবস্থা, এখনকার মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করবে না।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, এ খাল থেকে মাছ শিকার করে বিক্রি করতাম। এক সময় প্রচুর মাছ ছিল। এখন মাছের পরিবর্তে ময়লা-আর্বজনার পোকা কিলবিল করছে।
মান্দারী এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ বলেন, মান্দারী বাজারের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমতখালী খালে অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। বাজারের ময়লা-আর্বজনা এবং গরু ছাগলের বর্জ্য ফেলে খাল দূষণ করা হয়েছে। বাজারের ভেতের থাকা অনেক স্থাপনার অংশ খালের উপর।

লক্ষ্মীপুর প্রেসকাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর ফরহাদ হোসেন সুমন বলেন, দস্যুরা খাল দখল করলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয় না। রহমতখালী খালের দখল এবং দূষণ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করলেও বিষয়টি যেন প্রশাসনের নজরেই আসে না। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও তারা দায়সারা বক্তব্য দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে দেয়।
আমাদের দাবি, প্রশাসন যাতে রহমতখালী খালকে অবৈধ দখল এবং দূষণমুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। দূষণ রোধে পৌর কর্তৃপকেও আরও আন্তরিক হতে হবে। বাজারের ময়লা ফেলার জন্য  আলাদা ডাষ্টবিন করে দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

রহমতখালীর এমন পরিণতির বিষয়ে পৌর মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া বলেন, দখল এবং দূষণের কারণে খালের অবস্থা একেবারে বেহাল। বাজারে ময়লা আর্বজনা এবং বাসাবাড়ির ময়লার পাইপ লাইন খালে দেওয়া হয়েছে। মানুষ সচেতন না। এ কারণে তারা খালটি দূষণ করছে। আমরা মাঝেমধ্যে খাল পরিষ্কার করি। কিন্তু অসচেতন মানুষরা আবার খাল দূষণ করে ফেলে। লোকজনকে সচেতন করা গেলে এবং খালকে বেদখল করা গেলে অস্তিত্ব টিকানো যাবে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের রায়পুর পওর বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী গোকুল চন্দ্র পাল বলেন, রতমতখালী খালের ১৮ কিলোমিটার খনন করার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। খালটি সংস্কার করা গেলে দূষণ রোধ হবে।

লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব; উন্নয়ন ও মানব সম্পদ) পদ্মাসন সিংহ বলেন, অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে তালিকা তৈরী করে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানে হবে।

 

রিলেটেড নিউজ

লক্ষ্মীপুরে বিস্ফোরণে নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন

লক্ষ্মীপুরে বিস্ফোরণে নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন

উপকূল ডেস্ক: : লক্ষ্মীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ জন নিহত ও ২০ জন আহতের ঘটনায় তথ্য  ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে...বিস্তারিত


লক্ষ্মীপুরে বাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত ৩, অগ্নিদগ্ধ ২০

লক্ষ্মীপুরে বাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত ৩, অগ্নিদগ্ধ ২০

উপকূল ডেস্ক: : লক্ষ্মীপুরে একটি বাসে গ্যাস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও অন্তত ২০ জন দগ্ধ হয়েছে। ...বিস্তারিত


 শেখ হাসিনাসহ খুনিদের দ্রুত বিচার করতে হবে: এ্যানি

শেখ হাসিনাসহ খুনিদের দ্রুত বিচার করতে হবে: এ্যানি

উপকূল ডেস্ক: : আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌ...বিস্তারিত


লক্ষ্মীপুরে পুলিশের বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

লক্ষ্মীপুরে পুলিশের বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

উপকূল ডেস্ক: : বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অধঃস্তন পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা অনুষ্ঠি...বিস্তারিত


লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানববন্ধন

লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানববন্ধন

মো. মাহবুবুল আলম মিন্টু : অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন ...বিস্তারিত


দুর্ভোগে লক্ষ্মীপুরের লক্ষাধিক মানুষ

দুর্ভোগে লক্ষ্মীপুরের লক্ষাধিক মানুষ

উপকূল ডেস্ক: : প্রায় দেড় মাস আগে লক্ষ্মীপুরে বন্যা হয়েছে। এক মাসের মাথায় বেশিরভাগ এলাকার পানি নেমে গেলেও কিছু কি...বিস্তারিত



সর্বপঠিত খবর

ভেজা সুপারিতে মেশানো হচ্ছে হাইড্রোজ

ভেজা সুপারিতে মেশানো হচ্ছে হাইড্রোজ

মো. মাহবুবুল আলম মিন্টু : লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পুকুর ও উন্মুক্ত জলাশয়ে সুপারি ভিজিয়ে দূষিত করা হচ্ছ...বিস্তারিত


পাহাড়ের পর্যটনে চলছে বিষাদের ছায়া, হতাশা কাটিয়ে ওঠার আশা

পাহাড়ের পর্যটনে চলছে বিষাদের ছায়া, হতাশা কাটিয়ে ওঠার আশা

উপকূল ডেস্ক: : ‘চলো দোতং পাহাড় জুম ঘরে, পূর্ণিমা রাত বর্ষা জুড়ে জীবন জুয়ার আসর বসাবো’ গানের মতো পর্যটকরাও স...বিস্তারিত



সর্বশেষ খবর